প্রকাশিত: ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৬, ২০২৫
-দুলাল মিয়া : হিজলগাছ। হাওরাঞ্চলের চিরচেনা বৃক্ষ। এটি প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের আধার। হাওরের উত্তাল জলে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে প্রবল প্রাণশক্তির হিজলগাছ। কখনো একা, কখনো সারিবদ্ধভাবে। পানিতে দাঁড়িয়ে বর্ষায় হাওরের সৌন্দর্যকে অনন্য করে তোলে হিজলগাছ।
হাওরে হিজলগাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। এই গাছ নানাভাবে হাওরের জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি ও উপকার করে। হিজলগাছ বন্যার পানি কিংবা তীব্র খরাতেও টিকে থাকে। এমনকি পানির নিচে কয়েক মাস নিমজ্জিত থাকলেও টিকে থাকে, মরে না। এই গাছ জলা জায়গার আশে পাশে বেশি দেখা যায়। প্রচণ্ড গ্রীষ্মেও গাছটি বেঁচে থাকতে পারে।
হাওরাঞ্চলে এ গাছের ডাল মাছের অভয়রাণ্য তৈরিতে অত্যন্ত উপযোগী। অযত্ন-অবহেলা ও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চিরচেনা হিজলগাছ। হাওরের জাঙ্গাল, বাড়ির কিনার, কান্দা, খাল, বিল, নদী-নালা, হাওর, বাঁওর ও ডোবার ধারে হিজলগাছ জন্মে। হিজলের কাঠ নরম, সাদা বর্ণের, উজ্জ্বল, মসৃণ ও টেকসই। পানিতে নষ্ট হয় না বলে নৌযান তৈরিতে এর কাঠ ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি হিসেবেও এর ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে।
হিজল ফুল ফোটে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। হালকা গোলাপি রঙে হিজল ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। গভীর রাতে ফুল ফোটে। সকালে ঝরে যায়। ফুলে এক ধরনের মিষ্টি মাদকতাময় গন্ধ আছে। হিজলগাছ পশু-পাখি ও মাছের আশ্রয়স্থল। বর্ষায় হাওরে ঝড়ের কবলে পড়লে নৌকারোহীরা আশ্রয় নেন হিজলগাছে।
অন্যদিকে হিজল গাছের শেকড় মাটিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে, ফলে হাওরের পাড় ও আশপাশের এলাকা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায়। বর্ষার সময় এটি বন্যার পানি শোষণ করে ও পানির গতি নিয়ন্ত্রণ করে, যা প্লাবন প্রতিরোধে সাহায্য করে।মাটির ক্ষয়রোধ এবং বাঁধ রক্ষার কাজেও এর ভূমিকা অনেক।
হিজলগাছ জেলে ও কৃষকের বন্ধু। প্রখর রোদে কৃষক এর ছায়ায় আশ্রয় নিতে পারেন। আফাল – তুফান ও ঢেউয়ে ঘরবাড়ি ভাঙ্গনেরর হাত থেকে এটি প্রতিরক্ষার কাজও করে। হাওরাঞ্চলের বিল, নদী-নালা ও জলাশয়গুলোতে হিজলের ডাল কাঁটা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাছের অভয়াশ্রম তৈরিতে হিজলের ডালপালার ব্যবহার বহুল প্রচলিত। অভয়াশ্রম তৈরিতে এর জুড়ি মেলা ভার। হিজল গাছের ছায়ায় হাওরের মাছ, ব্যাঙ, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীরা আশ্রয় ও খাদ্য পায়। এর শেকড়ে অনেক জলজ প্রাণীর প্রজনন ঘটে, যা হাওরের প্রাণীকুলকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।হিজলগাছ হাওরের পানি সংরক্ষণে সাহায্য করে বলে কৃষিজমির উর্বরতা বজায় থাকে । ফলে কৃষকরা ভালো ফসল উৎপাদন করতে পারেন।
হিজল মাঝারি আকারের চিরহরিৎ গাছ। উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ মিটার। ‘Barringtonia acutangula’এর বৈজ্ঞানিক নাম। এটি মাঝারি আকারের ডালপালা ছড়ানো দীর্ঘজীবী গাছ। সংস্কৃত নাম ‘নিচুল’। হিজল ফুল শেষ হলে গাছে ফল আসে। ফল তিতা ও বিষাক্ত। দেখতে অনেকটা হরীতকীর মতো। হিজলের বিষাক্ত অংশ হলো ফল। হিজলগাছের প্রাণশক্তি প্রবল। গাছটির দুটি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। ফুল হয় সাদা ও লাল। পুষ্প মঞ্জুরী কাণ্ড থেকে ঝুড়ির মতো ঝোলে। গাছের বিষাক্ত অংশ হলো কাঁচা ফল। হিজলের শুকনো ফলের বীজ শুকিয়ে গুঁড়ো করে খেলে পেটের অনেক সমস্যা দূর হয়। এছাড়াও গাছটির অনেক ঔষধিগুণ রয়েছে।
নিজ সৌন্দর্যের গুণে বাংলা সাহিত্যে ঠাঁই পেয়েছে হিজলগাছ। হিজলগাছের রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে অনেক কবিই কবিতা রচনা করেছেন। কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার রূপের সঙ্গে হিজল গাছের ছায়াকে তুলনা করে লিখেছিলেন, “এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ।” কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- “হিজল বিছানো বন পথ দিয়া/রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।” বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন- “হাওরের পানি নাই রে হেথায়, নাই রে তাজা মাছ/বিলের বুকে ডালা মেলা, নাই রে হিজলগাছ।”
হাওরের চিরচেনা হিজলগাছ দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে।আগে হাওরের জাঙ্গাল, বাড়ির হালট, রাস্তার কিনার, কান্দা, খাল, বিল, নালা, হাওর, ডোবার ধারে ও নদীর তীরে সারি সারি হিজল গাছ ছিল। গেল কয়েক বছর ধরে কারণে-অকারণে এসব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে।হাওরের বাঁধের কাজের মাটি নেওয়া হয় কান্দা কেটে। এ জন্য এখন কান্দার অস্তিত্বই হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে হাওর অঞ্চলের হিজল- করচগাছসহ বন বাদাড় উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
বিলে মাছ সংরক্ষণের জন্য এই গাছ খুবই মূল্যবান।আমাদের প্রয়োজনেই গাজগুলো রক্ষা করতে হবে। হাওরের পরিবেশের দিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। হাওরে গাছ-মাছ না থাকলে আমরা হাওরবাসী বাঁচতে পারবো না। এজন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রশাসনেরও কঠোর ভূমিকা দরকার ।
হাওর অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের পথে। হাওর এলাকায় হিজল-করচ গাছ কমে যাওয়ায় পাখি, বন্যপ্রাণী ও মাছের অভয়াশ্রম ধ্বংস হয়েছে। হাওরগুলোতে আগের মতো মাছ নেই, পাখি নেই। পরিযায়ী পাখির আনাগোনাও আগের মতো নেই। একেবারেই কমে গেছে। হাওরগুলো অরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে। হাওর এলাকায় বনায়নের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাওর অঞ্চলের জন্য বিশেষ বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করলে প্রকৃতি হয়তো তার পূর্বের রূপ ফিরে পাবে। হাওরাঞ্চল ফিরে পাবে তার আসল চেহারা। হাওর হবে সুরক্ষিত । হাওরে বড় বড় মাছ হবে, পাখি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবও রোধ করা যাবে। হাওরগুলোতে মিঠাপানির মাছের নিরাপদ বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র তৈরি হবে।
হিজল গাছ শুধু একটি গাছ নয়। এটি হাওরের শক্তি। হাওরের বাস্তুসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিজলগাছকে টিকিয়ে না রাখলে হাওরের ভূমিক্ষয়, জলজ প্রাণীর ক্ষতি, বন্যা সমস্যা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব আরও প্রকট হবে। তাই হিজল গাছ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি।
লেখক : প্রভাষক, জাউয়া বাজার ডিগ্রি কলেজ।
উপদেষ্টা মন্ডলির সভাপতি : লন্ডন প্রবাসি বিশিষ্ট সমাজকর্মী কবি ইমদাদুন খান
সম্পাদক : জাকিয়া সুলতানা মনি
প্রধান বার্তা সম্পাদক : আবুল হোসেন
যোগাযোগ: চিফ নিউজ এডিটর: আবুল হোসেন, সুরমা মার্কেট সিলেট, +8801725167503
জয়েন্ট নিউজ এডিটর: আব্দুস সামাদ আফেন্দি নাহিদ, সুনামগঞ্জ +8801312125827
হেড অব নিউজ: মোসফিকুর রহমান স্বপন, সুনামগঞ্জ 01756464823
ডেক্স ইনচার্জ: রোকন উদ্দিন,তাহিরপুর +8801785752013
ইমেলঃ vatirkantho@gmail.com
Design and developed by Web Nest