স্মৃতির পাতায় হাওরের নক্ষত্র খ্যাত মরহুম নজির হোসেন

প্রকাশিত: ৩:২৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩০, ২০২৪

স্মৃতির পাতায় হাওরের নক্ষত্র খ্যাত মরহুম নজির হোসেন

তাহিরপুর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি :

নজির হোসেন ১৯৪৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শাহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. আব্দুল গণী ও মাতার নাম ছুরত উন নিসা। এটি ঐতিহাসিক লাউর রাজ্যে কাগজী পরিবার নামে খ্যাত এক সম্ভ্রান্ত বংশ। পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত পরিবারটি তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। বাবা ছিলেন একজন ধার্মিক মৌলানা এবং ছোট পল্লী চিকিৎসক। শিশুকাল থেকেই নজির হোসেন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। পঞ্চম শ্রেণিতে স্কলারশিপ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বৃত্তি পান। দারিদ্রের কারণে সেই বাল্যকাল থেকেই টিউশনি করে পড়াশুনা চালিয়ে যান। অষ্টম শ্রেণি পাশের পর বাবা আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশুনা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মা ছেলের পড়াশুনার পক্ষে ছিলেন। মা সুয়েতুন নেছা’র কাছ থেকে চার আনা পয়সা চেয়ে নিয়ে সেই ১৯৫৭ সালে ভাগ্য এবং নিজের দৃঢ় মনোবলের উপর নির্ভর করে বাড়ি থেকে অজানার পথে বেরিয়ে পড়েন। পরবর্তিতে নজির হোসেন ১৯৬৩ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পাশ করেন। সে সময়ে প্রথম বিভাগ একমাত্র অনন্য মেধাবী ও চরম অধ্যবসায়ী ছাত্রেরাই পেতেন। এরপর সিলেট এম.সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় এইচ.এস.সি এবং বি.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস.সি (গণিত) তে ভর্তি হন। সেদিনের সেই তুখোড় মেধাবী ছাত্র ফিরে আসেন সংগ্রামী জননেতা হিসেবে। বড় চাকরী করে নিজের ও পরিবারের ভাগ্যোন্নয়নের চেয়ে সমাজ বদলের রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরেন।

ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন নজির হোসেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে সিলেট জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এবছরই শেষের দিকে সুনামগঞ্জ জেলা সিপিবির দায়িত্ব লাভ করে দলকে সংগঠিত করতে চলে আসেন সুনামগঞ্জে। সুনামগঞ্জ মহকুমার গোপন কমিউনিস্ট সেলের প্রধান ছিলেন নজির হোসেন। কমিনিষ্ট পার্টি ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও কৃষক সমিতি পরিচালনা করতেন। নজির হোসেন ১৯৭১ সালে সুনামগঞ্জ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সহসম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালে জুনের প্রথম দিকে শিলংয়ের সানী হোটেলে কমরেড বরুণ রায়, পীর হাবিবুর রহমান, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও সরদার লতিফের উপস্থিতিতে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের আলোকে টেকেরঘাট সাব সেক্টর একটি গেরিলা যুদ্ধের জোন হিসেবে গড়ে ওঠে। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত সেক্টর কমাণ্ডার ও নজির হোসেন টেকেরঘাট সাব সেক্টরের সহ—অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৪ সালে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে ১৮ মাসব্যাপী রাজনৈতিক পড়াশুনার জন্যে মস্কোতে ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৪ বছর আত্মগোপনে ছিলেন এবং মুস্তাক সরকার বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে সুনামগঞ্জ অঞ্চলের স্বার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৫ সালে নিরাপত্তা আইনে ৬ মাস কারাবরণ করেন। সুনামগঞ্জের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নজির হোসেন ১৫ দলীয় জোটের নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভাসান পানির আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, তবে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে কখনো পিছপা হননি। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিপিবি থেকে ৮ দলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হয়ে নজির হোসেন প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন।

পঞ্চম সংসদে নৌ—পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন নজির হোসেন। আশির দশকের সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্লাসনষ্ট, পেরেস্ত্রাইকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও এর প্রভাব পড়ে। নব্বই দশকের প্রথম দিকে সিপিবি ভাঙ্গতে শুরু করলে মূলদল থেকে গণফোরাম, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দলে সিপিবি’র নেতাকর্মীরা যোগ দিতে শুরু করেন। তখন নজির হোসেন ১৯৯৩ সালের ১৫ অক্টোবর বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি প্রথমে সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সভাপতি নির্বাচিত হন। ছিলেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। ১০ বছর সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও ৫ বছর জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আমৃত্যু সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির নির্বাহী সদস্য ছিলেন।

১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজির হোসেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ৮ম সংসদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। এর আগে ১৯৯১ সালে সিপিবি থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সুনামগঞ্জ—৪ ও সুনামগঞ্জ—১ এই দুই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন তিনি। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সুনামগঞ্জ—১ থেকে তিনি বিএনপির প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন।

সুনামগঞ্জ—১ নির্বাচনী এলাকার অর্থনৈতিক জীবনমানের উন্নয়নের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। হাওরের ফসল রক্ষায় বহুমাত্রিক আন্তরিক প্রচেষ্টা ও বাঁধে বাঁধে পথসভা জনগণের প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। যোগাযোগ, শিক্ষা, হাওর উন্নয়ন (বন্যা নিয়ন্ত্রণ, আগাম বন্যা প্রতিরোধ সহ) কৃষি, শিল্পায়ন, পর্যটন ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারার রূপকল্প সারা নির্বাচনী এলাকার চেহারা একেবারেই পাল্টে দিতে পারে। সুনামগঞ্জ—১ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন কৌশল নিয়ে তাঁর গবেষণামূলক লেখা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে।মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ নিয়ে তার লেখা বই সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে দেখেছি। প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। নজির হুসেন এর অভাব পূরন হবার নয়।