দিরাইয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত হলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রসুল

প্রকাশিত: ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০২৩

দিরাইয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত হলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রসুল

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি ; বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও রিপোর্টার্স ইউনিটির সহ-সভাপতি সাংবাদিক আল-হেলালের পিতা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এস.এন.এম মাহমুদুর রসুল (ময়না মাস্টার) ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
বার্ধক্যজনিত কারনে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর শনিবার (২১ অক্টোবর) দুপুরে ৭১ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে সহ অসংখ্য গুনগ্রাহী আত্মীয়স্বজন রেখে গেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এন.এম মাহমুদুর রসুল জীবদ্দশায় বিভিন্ন রাজনৈতিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবিসহ অসংখ্য সমাজ কল্যানমুলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি দিরাই থানা আওয়ামীলীগের প্রথম কার্যকরী কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র সংগঠকের পাশাপাশি প্রথমসারীর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাহমুদুর রসুল সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাক বাহিনীর সাথে সশস্ত্র লড়াই করে গুরুতর আহত হন। তাঁর সহযোদ্ধা শান্তিগঞ্জ উপজেলার আস্তমা গ্রাম নিবাসী বীর মুক্তিযুদ্ধা আরশ আলী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের বাবনিয়া যুদ্ধে গুরুতর আহত হওয়ার পর প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ হারিস উদ্দিন,ডাঃ জালাল আহমদ ও ডাঃ এমইউ কবীর চৌধুরী (পরবর্তীতে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত) এর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে তিনি আবারও আওয়ামীলীগ নেতা হোসেন বখত ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপির নির্দেশে জামালগঞ্জের বেহেলী,তাহিরপুর ও দিরাই উপজেলার বিভিন্ন রনাঙ্গনে কৃতিত্বের সাথে লড়াই করেন। তিনি সুনামগঞ্জে ৫নং সেক্টরের অধীনস্থ টেকেরঘাট সাব সেক্টরের এম.এ মজিদ চৌধুরী মানিক কোম্পানীর সহ অধিনায়কের দায়িত ¡পালন করেন। পরবর্তীতে দায়িত্ব পালন করেন কোম্পানী অধিনায়ক হিসেবে। ছাত্রজীবনে তিনি একজন কৃতি ফুটবলার হিসেবে পুরো সিলেট অঞ্চলে সুখ্যাত ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই তিনি সুনামগঞ্জের প্রখ্যাত সাংবাদিক ভাষা সৈনিক আব্দুল হাই সম্পাদিত সাপ্তাহিক সুর্যের দেশ পত্রিকায় বার্তা সম্পাদক ও মুর্শেদী প্রেসে ম্যানাজার হিসেবে চাকুরী করেন। পরে বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে চাকুরী লাভ করেন। কিন্তু মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে পুলিশের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ১৯৭৩ সালে সংসদ নির্বাচনের পরপরই মহান পেশা শিক্ষকতায় যোগদান করেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দিরাই থানা ইউনিট কমান্ড এর আহবায়ক ও উপজেলা কমান্ডার হিসেবে দীর্ঘদিন সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসরগ্রহণ করেন। চাকুরীকালীন সময়ে দিরাই ও ছাতক উপজেলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। জীবদ্দশায় তিনি দিরাই কালনী নাট্যগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। একজন গীতিকার হিসেবে সুনামগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি অনেক অবদান রেখে গেছেন। মৃত্যুর পর্বে বড় ভাই প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক ও শিক্ষক চিকিৎসক ডাঃ আব্দূন নূর চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত মজলিশপুর জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও মাওলানা গিয়াস উদ্দিন পরিচালিত হযরত ফাতেমাতুজ যাহরা (রাঃ) মহিলা মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। শনিবার (২১ অক্টোবর) দুপুরে দিরাই পৌরসভার মজলিশপুরস্থ নিজ বাসভবনে তিনি ইন্তেকাল করেন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান কীর্তিমান এই গুণী ব্যাক্তির মৃত্যুর সংবাদে পরিচিত মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
শনিবার বিকেল ৫টায় দিরাই জামেয়া হুসাইনিয়া মাদ্রাসা মাঠে দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান মামুন ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মুক্তাদির হোসেন এর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ সময় দিরাই পৌরসভার মেয়র বিশ্বজিত রায়,বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম আজাদ,সাবেক কমান্ডার আব্দুল করিম,বীর মুক্তিযোদ্ধা কুমুদ রঞ্জন দাস,বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাদিক,উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী আমিন সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পরে একইস্থানে বাদ মাগরিব সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মরহুমের নামাজে জানাযা শেষে স্থানীয় মজলিশপুর কবরস্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এন এম মাহমুদুর রসুলকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
মরহুমের জেষ্টপুত্র সাংবাদিক আল-হেলাল বলেন,আমার পিতা একাধারে একজন ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ নেতা,সাবেক মন্ত্রী আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ আজাদ ও অক্ষয় কুমার দাশের রাজনৈতিক কর্মী,রণাঙ্গনের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা,সাংবাদিক,শিক্ষক,নাট্যাভিনেতা,ফুটবলার,ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং সফল শিক্ষক ছিলেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের প্রথম ছাত্র জননেতা এম মুহিবুর রহমান মানিক বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৪ বারের নির্বাচিত এমপি ও ২ বারের নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান। এছাড়া তাঁর আরেকজন ছাত্র প্রফেসর তারেক আহমদ সিলেটের বিয়ানীবাজার ডিগ্রী কলেজের ইংরেজী বিভাগীয় প্রধানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক নামকরা ছাত্ররা কর্মক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করে চলেছেন। তাঁর আপন চাচাতো ভাই বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার লামাপাড়া নিবাসী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম সামছুল ইসলাম বালাট সাবসেক্টরের বৈশারপাড় গ্রামে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে আহত হয়ে এখনও পঙ্গুত্ববরন করে চলেছেন। আল-হেলাল বলেন,আমার পিতা গত ৭ মাস যাবৎ একাধারে লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সার ব্যাধিতে ভূগছিলেন। ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল এর তত্ত¡াবধানে তার দেহে দুটি অপারেশন হওয়ার পর তিনি ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়েন এবং দীর্ঘ চিকিৎসাকালীন অবস্থায় তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
দিরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদুর রহমান মামুন বলেন,বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আজীবন সততা দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে দেশকে সেবা দিয়েছেন। তিনি কখনও আমাকে নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কোন কথা বলেননি। সবসময় অন্যের সমস্যা শেয়ার করতেন। আমাকে নিজের পুত্রের মতো শ্রদ্ধা করতেন। এ পর্যন্ত আমি প্রায় ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত করতে পেরেছি। আজ তাকে দাফন করতে পেরে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি। সততা ও নিষ্ঠার গুনে আল্লাহর কাছে তিনি পুরস্কৃত হবেন এই প্রত্যাশা ও দোয়া করছি।
দিরাই থানা ওসি কাজী মোক্তাদির হোসেন বলেন,মহান এই দেশপ্রেমিক বীর সেনানী নিজের পুত্র কন্যা ভাতিজা ভাতিজিকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী,সেনাবাহিনী ও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রেখে দেশসেবায় মত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিবেদিত রেখেছিলেন।
পৃথক পৃথক বিবৃতিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এন.এম মাহমুদুর রসুল এর আকস্মিক মৃত্যুতে সুগভীর শোক প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আলহাজ্ব এম.এ মান্নান এমপি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি,সুনামগঞ্জ ২ আসনের সংসদ সদস্য ড.জয়াসেন গুপ্তা,সুনামগঞ্জ ৫ আসনের সংসদ সদস্য জননেতা এম মুহিবুর রহমান মানিক, সুনামগঞ্জ ১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন,সুনামগঞ্জ ৪ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ,সুনামগঞ্জ-সিলেট সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট শামীমা আক্তার খানম শামীমা শাহরিয়ার, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুরুল হুদা মুকুট,বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য সাবেক এমপি আলহাজ্ব মতিউর রহমান,সুনামগঞ্জ-মৌলভীবাজার সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এডভোকেট শামছুন নাহার বেগম শাহানা রব্বানী,যুদ্ধকালীন কোম্পানী কমান্ডার এডভোকেট আলী আমজাদ বড় ভাই, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত,সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন,সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি অধ্যক্ষ শেরগুল আহমেদ,সাধারণ সম্পাদক রওনক আহমদ বখত,সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান পীর,সাবেক সভাপতি লতিফুর রহমান রাজু ও সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী এমরানুল হক। তারা মরহুম মুক্তিযোদ্ধার আত্মার মাগফেরাত ও তাঁর শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।

সুনামগঞ্জ
তারিখ-২৩.১০.২০২৩ইং
মোবাইল-০১৭১৬-২৬৩০৪৮